এই বছর শীতের প্রকোপ কম থাকায় খেজুর গাছ থেকে ভালো মানের রস সংগ্রহ করছেন গাছীরা। রসের পরিমাণও বেশি এবং গুড় উৎপাদনও হচ্ছে বেশি পরিমাণে। এবার ভাল আবহাওয়ার কারণে গাছীরা আশা করছেন প্রায় ৫০০ মণ হাজারী গুড় বানাতে পারবেন তারা।
ক্রেতারা হাজারী গুড় কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন গাছীদের বাড়িতে বাড়িতে। বর্তমানে প্রতি কেজি হাজারী গুড় বিক্রি করা হচ্ছে সর্বনিম্ব ১০০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা পর্যন্ত।
জানা গেছে, প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা, গালা, বাল্লা, গোপীনাথপুর, কাঞ্চনপুর, রামকৃষ্ণপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়।

দেড়শ বছর আগে হাজারী প্রামানিক নামে এক দরবেশ ওই অঞ্চলের এক গাছীর কাছ থেকে খেজুর রস খাওয়ার পর তাকে গুড় তৈরির কৌশল শিখিয়ে দেন। সেই থেকে খেজুর রস দিয়ে তৈরি গুড় বেশ সুস্বাদু হয়। দরবেশের নাম অনুসারে গুড়ের নামকরণ করা হয় হাজারী গুড়।
এরপর থেকে এখন পর্যন্ত শীতের তিন মাস পর্যন্ত হাজারী গুড় তৈরি করতে শীত মৌসুমে ব্যস্ত সময় পার করে মানিকগঞ্জের গাছীরা। তবে দিন দিন খেজুর গাছ ও গাছী কমে যাওয়ায় গুড়ের উৎপাদনও কমে গেছে। ওইসব এলাকায় আগে শতাধিক গাছী পরিবার থাকলেও বর্তমানে হাজারী গুড় তৈরী করছেন ৫০ থেকে ৬০ গাছী পরিবার।
হরিরামপুরের ঝিটকা এলাকায় গিয়ে প্রতিটি গাছীবাড়ির উঠানে ভোর থেকে গাছীদের গুড় তৈরি করার ব্যস্ততা দেখা গেছে। গাছীবাড়ির নারী সদস্যরাও গুড় তৈরিতে পুরো সহযোগিতা করছেন। কাঁকডাকা ভোর থেকে শুরু করে বেলা ১০টা পর্যন্ত চলে গাছীবাড়ির গুড় তৈরির কর্মযজ্ঞ।
গাছীরা জানান, সব রসে হাজারী গুড় হয় না। হাজারী গুড় বানাতে হলে সপ্তাহের চারদিন খেজুরগাছ শুকিয়ে রাখতে হয়। বাকী তিনদিন গাছ কেটে রস সংগ্রহ করতে হয়। এছাড়া বিশেষ কায়দায় খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহর পর বিশেষ পদ্ধতিতে মাটির হাঁড়িতে রস আগুনে জ্বাল দিয়ে হাজারী গুড় তৈরি করা হয়। এতে অতিরিক্ত খাটা-খাটুনী করতে হয় গাছীদের।
হরিরামপুর উপজেলার শিকদার পাড়ার গাছী আবদুস সালাম বলেন, গত ৪০ বছর ধরে তিনি খেজুর গাছ কেটে গুড় বানিয়েছেন। এখন তার বয়স ৬৫ বছর। বয়সের কারণে আগের মত খাটা-খাটুনি করতে পারেন না তিনি। কিন্তু ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছেন তার দুই ছেলে। তারাই এখন হাজারী গুড় তৈরি করেন।

তিনি বলেন, হাজারী গুড় তৈরিতে বেশ পরিশ্রম করতে হয়। সপ্তাহের একদিন বাদ দিয়ে একদিন খেজুর গাছ কাটা হয়। প্রথম কাটার রস দিয়ে তৈরি হয় হাজারী গুড় । প্রতিদিন যে পরিমাণ রস হয় তাতে দিনে ৪ থেকে ৫ কেজি হাজারী গুড় তৈরি করতে পারেন। আগে থেকেই ক্রেতারা হাজারী গুড়ের অর্ডার দিয়ে রাখেন। তিন-চারদিনের গুড় একত্রিত করে ক্রেতার চাহিদা মেটানো হয়।
গুড়ের এই কারিগর জানান, প্রতি কেজি হাজারী গুড় বিক্রি করছেন ১০০০ থেকে ১২০০টাকায়। এই মৌসুমে তার পরিবার থেকে ২৫ মন হাজারী গুড় তৈরী করতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি। যার বিক্রয়মূল্য প্রায় ৩০ হাজার টাকা। এরই মধ্যে তিনি প্রায় বিশ হাজার টাকার হাজারী গুড় বিক্রি করেছেন।
ওই এলাকার গাছী সিদ্দিক সর্দার বলেন, তিনি ১৬ বছর ধরে হাজারী গুড় তৈরি করছেন। এবার ১৫০টি খেজুর গাছ থেকে তিনি রস সংগ্রহ করছেন। এর মধ্যে ১০০টি গাছ ৪০০ টাকা দরে চার মাসের জন্য কিনেছেন। বাকী ৫০টি বর্গায় নিয়েছেন। বর্গাদার হিসেবে মালিককে অর্ধেক রস দিয়ে দেন। বাকী অর্ধেক নিজের থাকে। তা দিয়ে গুড় তৈরি করেন। অগ্রহায়ণ মাস থেকে গাছ কাটা শুরু করে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত কাটবেন। তিনি প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ কেজি করে হাজারী গুড় বানান। বাকী রস দিয়ে লাল গুড় তৈরি করেন। আর প্রতি কেজি হাজারী গুড় বিক্রি করেন ১২০০ টাকায়।
অন্যান্য গাছীরাও জানান, এবারের শীতে ঘন কুয়াশার প্রকোপ কম থাকায় ভালো মানের খেজুর রস পাওয়া যাচ্ছে। এতে হাজারী গুড়ের উৎপাদন বেড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ৬ মন হাজারী গুড় তৈরি করছে গাছীরা। তবুও চাহিদা অনুযায়ী গুড় দিতে পারছেন না ক্রেতাদের। অনেক ক্রেতাই আগে থেকেই অর্ডার করছেন গুড়ের।

এদিকে হাজারী গুড় কিনতে ক্রেতারা খুব ভোরে ভিড় করছেন গাছী বাড়ীগুলোতে। গাছ থেকে রস পাড়া, জ্বাল দেয়া,গুড় তৈরী করা সবই নিজের চোখে দেখে টাটকা হাজারী গুড় কিনছেন। প্রতি কেজি ১০০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকায় দাম দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী গুড় কিনতে পারছেন না ক্রেতারা। চাহিদা অনুযায়ী গুড় নিতে হলে আগে অর্ডার দিতে হয়।
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক এসএম ফেরদৌস জানালেন, হাজারী গুড় জেলার ঐতিহ্য বহন করায় সরকারিভাবে মানিকগঞ্জ জেলাকে (লোকজ গান আর হাজারী গুড়, মানিকগঞ্জের প্রাণের সূর) হাজারী গুড়ে ব্রান্ডিং করা হয়েছে।
ইতিপূর্বে ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথকে এই গুড় উপহার দিয়ে দেশের বেশ সুনাম হয়েছে।
তিনি বলেন, জেলা ব্র্যান্ড হিসেবে হাজারী গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে নতুন করে খেজুর গাছ লাগানো ও গাছীদের সহযোগিত করা হচ্ছে। শুধু তিন-চার মাস নয়, খেজুর গাছ থেকে যেন সারা বছরই রস সংগ্রহ করা যায় এবং হাজারী গুড় তৈরি করা যায়- সেব্যাপারেও চিন্তাভাবনা চলছে।